১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
জাগো
বাহে কোনঠে সবায়-
বাংলাদেশ,
মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া-ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে; বাংলাদেশে
ব্লগারদের নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার নিন্দা জানিয়ে সব মানুষের প্রতি জেগে ওঠার আহ্বান, পথে নামার
আহ্বান-
‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’
- সাহিত্য অঞ্জলি ব্লগের প্রতিবাদী উচ্চারণ।
সম্পাদকীয়-
একটি কথা, ধর্ম মানুষ হত্যার জন্য নয়। ধর্ম
মনুষ্যত্ববোধে উজ্বীবিত হওয়ার জন্য। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির
সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে ধর্মের বিধান পরিবর্তিত হয়েছে। সেটি মানুষের মঙ্গলের
জন্যই। সভ্যতার পথ পেছন নয়, সামনে এগিয়ে যাওয়া।
জোর করে মানবিকবোধ, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে রোধ করা যায় না। সংস্কৃতি নদীর মতো বহমান। সব সময় গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাবে। জাতপাত, গোত্র কিংবা ধর্ম যেন মানবতার মানদণ্ড না হয়, মানুষ মনুষ্যের মানদণ্ড। কারণ, সবার রক্তই এক। রক্ত কোনো ধর্মের ভেদ মানে না। মানে বিজ্ঞানকে।
বিজ্ঞান মানুষ্যত্বের সেবায়, সভ্যতার হাতিয়ার…ধর্মও হোক মানবতার হাতিয়ার। তাই, ধর্মান্ধতাকে, অদৃষ্টবাদিতাকে পরিহার করে নিজের বিবেক, বোধ হোক বিচারের মাপকাঠি। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। মানুষ হারিয়ে গেলে ধর্ম পালন করার কেউ থাকবে না। তাই, ধর্মের স্বার্থেই ভেদাভেদ ভুলে পৃথিবীর সব মানুষকে মানুষ ভেবে এবং পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করে মৃত্যুকালে যেন জবাব দিতে পারি, আমি মানুষের মঙ্গল কামনায় কিছু করার চেষ্টা করেছি।
জয় হোক মানুষের,
জয় হোক মানবতার।
বিনাশ হোক অশুভ শক্তির…
‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়…’
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
………………………………………………………………………………...
- সুকান্ত
ভট্টাচার্য
- বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
- আসাদ চৌধুরী
- মাহবুব উল আলম
চৌধুরী
- হেলাল হাফিজ
- শামসুর রাহমান
- জীবনানন্দ দাশ
- রুদ্র মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
- হুমায়ুন আজাদ
- কাজী নজরুল ইসলাম
…………………………………………………………………………….......
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
I don't want justice. I want human w'd be human: Professor Abul Kashem Fazlul Haque, father of the slain blogger and publisher Dipan |
দুর্মর
-
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হিমালয়
থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে
কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে
কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে
ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
হঠাৎ
নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম
নিয়েছে সচেতনতার দান,
গত
আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার
এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।
“হয়
দান নয় প্রাণ” এ শব্দে
সারা
দেশ দিশাহারা,
একবার
মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর
ভয় তারা।
সাবাস,
বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক
তাকিয়ে রয়
জ্বলে
পুড়ে-মরে ছারখার
তবু
মাথা নোয়াবার নয়।
এবার
লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালী
নয়কো, রক্তে রঙিন দান,
দেখবে
সকলে সেখানে জ্বলছে
দাউ
দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
২.
উদ্যোগ
(পূর্বাভাস )
বন্ধু,
তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ কর চিত্ত,
বাংলার
মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত
মূঢ়
শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে কর ছিন্ন,
একাগ্র
দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন |
ঘরে
তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে,
গাও
সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে |
আজ দৃঢ়
দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ কর শক্ত,
প্রতি
ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত |
আজকে
মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে
সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত |
ভীরু
অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেন আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন
দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য |
সব
প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পূব-দরজায়,
ফেণী
ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায় |
বন্ধু,
তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ম কর চিত্ত,
বাংলার
মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত ||
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
৩.
জাগবার
দিন আজ
জাগবার
দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে ;
যাদের
চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে------
তাদেরই
যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে,
মৃত্যুর
সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে |
আজকের দিন নয় কাব্যের -----
আজকের
সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের ;
শরতের
অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী,
কিন্তু
বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোন আসর-ই |
আকাশের
প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার----
মৃত্যু
ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার,
মৃত্যুর
কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট,
আজকের
এই কথা জানি লাগবেই অস্পষ্ট
|
তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা
থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না,
আজকে
যে প্রয়োজনে প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন ;
তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী
কোনখানে
ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিক্তি |
কোনখানে
লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব,
কোনখানে
দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;
পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো
বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;
সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির |
আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব
আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে ;
তাই
আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
একতাবদ্ধ হও এখনি ||
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
রাজা
আসে যায়
১
রাজা
আসে যায় রাজা বদলায়
নীল
জামা গায় লাল জামা গায়
এই
রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা
কাপড়ের রং বদলায়....
Deadbody of D. Avijit Roy |
দিন বদলায় না!
গোটা
পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের
সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে |
পেটের
ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনো জ্বলবে!
২
রাজা
আসে যায় আসে আর যায়
শুধু
পোষাকের রং বদলায়
শুধু
মুখোশের ঢং বদলায়
পাগলা মেহের আলি
দুই হাতে দিয়ে তালি
এই
রাস্তায়, ওই রাস্তায়
এই নাচে ওই গান গায় :
"সব
ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়!"
৩
জননী
জন্মভূমি!
সব
দেখে সব শুনেও অন্ধ
তুমি!
সব জেনে সব বুঝেও বধির তুমি!
তোমার ন্যাংটো ছেলেটা
কবে যে হয়েছে
মেহের আলি,
কুকুরের ভাত কেড়ে খায়
দেয় কুকুরকে
হাততালি...
তুমি বদলাও না ;
সে-ও বদলায় না!
৪
শুধু
পোষাকের রং বদলায়
শুধু
পোষাকের ঢং বদলায়...
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
২.
এই
নরকে
কবিরা
কোথায় আজ? উত্তরার জলসা-ঘরে এখনো কি নাচ সেখায় তারা?
এদিকে
যে শমীবৃক্ষে মন্ত্রপড়া অস্ত্রগুলি কীচকের বাড়ায় আহ্লাদ!
শুনি
পাড়ায় পাড়ায় জল্লাদের আস্ফালন ; দেখি ঘরে ঘরে
নরখাদকের রক্তমাখা থাবা,
পিশাচের মার...
কবিরা
কোথায় আজ? সবাই কি দুর্যোধনের কেনা,
নাকি
বিরাট রাজার ক্রীতদাস |
******************
তখন
সত্যি মানুষ ছিলাম
–
আসাদ চৌধুরী
নদীর
জলে আগুন ছিল
আগুন
ছিল বৃষ্টিতে
আগুন
ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস
করা দৃষ্টিতে।
আগুন
ছিল গানের সুরে
আগুন
ছিল কাব্যে,
মরার
চোখে আগুন ছিল
এ
কথা কে ভাববে ?
কুকুর-বেড়াল
থাবা হাঁকায়
ফোঁসে
সাপের ফণা
শিং
কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে
বালির কণা।
আগুন
ছিল মুক্তিসেনার
স্বপ্ন-ঢলের
বন্যায়-
প্রতিবাদের
প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিল
সব অন্যায়।
এখন
এসব স্বপ্নকথা
দূরের
শোনা গল্প,
তখন
সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন
আছি অল্প।
………………….
কাঁদতে
আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
–
মাহবুব উল আলম চৌধুরী
ওরা
চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা
প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার
জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা
প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি
দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের
ঐতিহ্য
কায়কোবাদ,
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য
ও কবিতার জন্য
যারা
প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের
মকবুল আহমদের
পুঁথির
জন্য
রমেশ
শীলের গাথার জন্য,
জসীম উদ্দীনের
‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা
প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি,
বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের
“খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার
দেশের মাটি।”
এ
দুটি লাইনের জন্য
দেশের
মাটির জন্য,
রমনার
মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার
অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি
তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত
বীজের খোসার মধ্যে
আমি
দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর,
আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি
দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার
সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের
মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক
একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে
থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের
সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের
মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ,
আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের
মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর
সভ্যতার
সবচেয়ে
প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই
চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা
সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা
গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা
এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা
তাদের কাছে
ভাষার
জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা
এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
আমরা
জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে
ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের
কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো
বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো
কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত
কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির
বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো
কারো বাবা কোনো
সরকারি
চাকুরে।
তোমারই
আমারই মতো
যারা
হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই
মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো
বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই
মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের
সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে
রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন
এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের
গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই
সব মৃতদের নামে
আমি
ফাঁসি দাবি করছি।
যারা
আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি
ফাঁসি দাবি করছি
যাদের
আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি
দাবি করছি
যারা
এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার
আসনে আরোহণ করেছে
সেই
বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি
তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা
ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের
গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার
দেশের মানুষ দেখতে চায়।
পাকিস্তানের
প্রথম শহীদ
এই
চল্লিশটি রত্ন,
দেশের
চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা,
বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই
পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার
গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন
ছিল
যাদের
স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো
গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের
স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী
ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার
সাধনা করার,
যাদের
স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’
চেয়েও সুন্দর
একটি
কবিতা রচনা করার,
সেই
সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে
তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে
হাজার বছর পরেও
সেই
মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে
দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
যদিও
অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন
তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা
করবে।
যদিও
ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি
পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু
তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই
মুছে যাবে না।
খুনি
জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো
দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের
সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন
আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির
দিন
হে
আমার মৃত ভাইরা,
সেই
দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের
কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার
বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে
আসবে
সেই
দিন আমার দেশের জনতা
খুনি
জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই
ঝুলাবে
তোমাদের
আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ
এবং বিজয়ের আনন্দে।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
ঘরোয়া
রাজনীতি
–
হেলাল হাফিজ
ব্যর্থ
হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী
মিছিলে এসো
স্লোগানে
স্লোগানে হবে কথোপকথন।
আকালের
এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী
পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল
শাড়িটা তোমার পরে এসো।
……………………………
-
শামসুর রাহমান
তোমাকে
পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে
পাওয়ার জন্যে
আর
কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর
কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি
আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা
বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির
সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি
আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের
বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের
মত চিৎকার করতে করতে
তুমি
আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস
বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর
মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি
আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি
আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে
দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি
আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ
শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে
পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর
কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর
কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা,
তোমার জন্যে এক থুত্থুড়ে বুড়ো
উদাস
দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল
আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা,
তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির
এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে
খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা,
তোমার জন্যে
হাড্ডিসার
এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে
আছে পথের ধারে।
তোমার
জন্যে,
সগীর
আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট
দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব
মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী
গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে
রুস্তম
শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন
পোকার দখলে
আর
রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই
তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি
নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই
অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর
এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন
নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই
বাংলায়
তোমাকেই
আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
অদ্ভুত
আঁধার এক
-
জীবনানন্দ
দাশ
অদ্ভুত
আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা
অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের
হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী
অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের
গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো
যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ
সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন
ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
বাতাসে
লাশের গন্ধ
আজো
আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো
আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার
কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ
দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে
লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে
লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই
রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ
জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ
তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ
যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা
– একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি
তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?
জাতির
পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাশে
লাশের গন্ধ
নিয়ন
আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে
রক্তের দাগ -
চালের
গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ
চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার
ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে
পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুণ্ডুহীন
বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর
ভেসে
ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা,
আমি ঘুমুতে
পারিনা…
রক্তের
কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে
আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা,
সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন –
স্বাধীনতা
– আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা
বোনের শাড়ী, ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
আমার
পরিচয়
-সৈয়দ
শামসুল হক
আমি
জন্মেছি বাংলায়
আমি
বাংলায় কথা বলি।
আমি
বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি
পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত
নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি
তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি
তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি
তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি
তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি
বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি
বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি
বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি
বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি
তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি
তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি
তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি
তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি
বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি
বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি
বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি
বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি
যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি
যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি
আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও
আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে
তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার
উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে
আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব
বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে
আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই
ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর
সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও
শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই
হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পড়েছি ফাঁস;
আপোষ
করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই
ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন
আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই
ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে
নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
বাঙলাদেশের
কথা (আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম)
- হুমায়ুন
আজাদ
যখন
আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে
দশটি
আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,
যখন
আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,
তখন
ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;
আমি
তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
তোমাকে
মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে
চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
অর্থনীতি,
ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের
দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি
তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।
তোমাকে
মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে
চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ
মাইলের
কথা: তার রাজনীতি
অর্থনীতি,
ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলী
জীবনযাপন,
হত্যা, ধর্ষণ
মধ্যযুগের
দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন
করে
আমাকে পীড়ন কোরো না
তার
ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু
প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি
তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
বিদ্রোহী
- কাজী
নজরুল ইসলাম
বল
বীর –
বল
উন্নত মম শির!
শির
নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল
বীর –
বল
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র
সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক
দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার
আসন “আরশ” ছেদিয়া
উঠিয়াছি
চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম
ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল
বীর –
আমি
চির-উন্নত শির!
আমি
চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-
প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি
মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি
দুর্ব্বার,
আমি
ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি
অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি
দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি
মানি নাকো কোনো আইন,
আমি
ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান
মাইন!
আমি
ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি
বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল
বীর –
চির
উন্নত মম শির!
আমি
ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি
পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি
নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি
আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি
হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি
চল-চঞ্চল, ঠুমকি’ ছমকি’
পথে
যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং
দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি
চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি
তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি
শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি
উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি
মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি
শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল
বীর –
আমি
চির-উন্নত শির!
আমি
চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি
দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
ভরপুর
মদ।
আমি
হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি
যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি
সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি
অবসান, নিশাবসান।
আমি
ইন্দ্রাণী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম
এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি
কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি
ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল
বীর –
চির
উন্নত মম শির।
আমি
সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি
যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি
বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি
আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি
বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি
ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি
পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি
চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি
ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি
দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি
প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি
মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি
কভু প্রশান্ত, – কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি
অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি
প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি
উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি
উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি
বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি
ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি
উন্মন মন উদাসীর,
আমি
বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি
বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি
অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
বুকে
গতি ফের!
আমি
অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-
চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি
গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি
চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি
চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি
যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি
উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি
পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি
আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি
মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! –
আমি
তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি
সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব
বাঁধ!
আমি
উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি
বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি
ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ-মর্ত্ত্য
করতলে,
তাজি
বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেস্বা
হেঁকে চলে!
আমি
বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি
পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি
তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি
ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি’ ভূমি-কম্প!
ধরি
বাসুকির ফনা জাপটি’, –
ধরি
স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’!
আমি
দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি
ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি
অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-
সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
ঘুম্
চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম
বাঁশরী তানে পাশরি’
আমি
শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি
রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে
সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি
বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি
প্লাবন-বন্যা,
কভু
ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা –
আমি
ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি
অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি
ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি
ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি
জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি
মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি
অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি
মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের
আমি চির দুর্জ্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর
আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি
তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি
উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি
চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব
বাঁধ!!
আমি
পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয়
করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি
হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি
উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি
সেই দিন হব শান্ত,
যবে
উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর
খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি
আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি
বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি
স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি
বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি
খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি
চির-বিদ্রোহী বীর –
আমি
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
নূরলদীনের সারা জীবন
- সৈয়দ শামসুল হক
নীলক্ষ্যা আকাশ নীল, হাজার হাজার তার ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর
হাজার।
ধবলদুধের মতো, জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার।
নষ্ট ক্ষেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন
সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নীলক্ষ্যার নীলে তীব্র শিষ
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের
প্রপাত?
গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হ’য়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরজ়ায়।
এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায় নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়-
কাল ঘুম যখন বাংলায়
তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায়।
নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল ১১৮৯ সনে।
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়,
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়।
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখেল্লায়-
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত ক’রে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়,
যখন আমারই দেশে এ আমারই দেহ থেকে রক্ত ঝড়ে যায়,
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝড়ে পড়ে
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রক্ষ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথাও যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
…………………………….
‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়? ’‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?’
No comments:
Post a Comment